আজ ১৬ই অক্টোবর। আজ আমার মায়ের চলে যাবার দিন৷ প্রতিবার কিছু না ক
আকাশপ্রদীপ
কার্তিক মাস পড়ে গেল প্রায়। রোদটাও তেমন গায়ে লাগছেনা আর। আমাদের একতলার ফ্লাটে এই সময় রোদ আসে। নির্দিষ্ট জায়গা আছে তার। বেশিক্ষন থাকেও না। একটুখানি দেখা দিয়েই পালায় সামনের জারুল গাছের গায়ে। অনেকক্ষন থাকে ওখানে। বেশ কিছু চেনা অচেনা পাখীও আসে এই সময়। এরা আগেও আসতো কিন্তু আমি দেখতে পেতাম না। অবসর জীবনে দেখি।
আমাদের ফ্লাটের সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাড়ার কুকুরগুলো রোদ পোয়াতে শুরু করে দিয়েছে এখন থেকেই। সামনের ফ্লাটের তিনতলায় প্রচুর পায়রা থাকে। সারাদিন একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে মুখে। বিশেষ করে নির্জন দুপুরে ওদের সেই নিভৃত আলাপ অন্য মাত্রা আনে আবহতে। আমাদের আবাসনে এখন ফেরিওয়ালা ঢোকে না। মাঝে মাঝে বড় রাস্তা থেকে শুনতে পাই তাদের অদ্ভুত ডাক।
অন্য জায়গার কথা বলতে পারবো না কিন্তু আমরা যারা উত্তর কলকাতায় জন্মেছি, বড় হয়েছি তাদের কাছে কার্তিক মাস হল আকাশপ্রদীপ দেবার মাস। প্রত্যেক বাড়ির ছাদে বিভিন্ন রঙের আকাশপ্রদীপ জ্বলতো। একটা বাঁশের লগাকে উঁচু করে বেঁধে দেওয়া হত চিলে কোঠার ছাদের মাথায়। তার ওপরে বিভিন্ন রঙের বাল্ব লাগিয়ে দেওয়া হত। তখন চাইনিজ আলো ছিল না। অনেক সময় সাদা বালবে রঙ্গীন কাগজ লাগানো হত। সে এক মায়াময় পরিবেশ। অনেক বাড়িতে আবার মাটীর প্রদীপ দেওয়া হত বাড়ির বাইরে। ওই যাদের ছাদ ছিল না তারা দিতেন।
এ সব ব্যাপারে আমার শিক্ষক ছিলেন মা। আকাশপ্রদীপ কেন? মা বলতেন এই সময় আমাদের পিতৃপুরুষেরা দেখতে আসেন আমরা কেমন আছি। তাদের পথা চেনার জন্যেই আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি আমরা। মিথ??? তাই হবে। তবে সেই বয়েসে মা ভুল বলছেন ভাবতেই পারতাম না।
কাল বড় রাস্তা দিয়ে ভিলায় ঢুকছি। রাত্তির এগারোটা হবে। একটু এগিয়েই আমাদের কেয়ারটেকারের ঘর। একটা জমাট সুন্দর গন্ধ পেলাম। দেখি ওদের বাড়ির পাশের শিউলি গাছটা সাদা হয়ে গেছে শিউলি ফুলে।অপুর্ব গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। প্রকৃতির নিজস্ব সুবাস!! ডানদিকে বাঁক নিলাম। বারোয়ারী জলের কলটাকে জড়িয়ে ধরে বেড়ে উঠেছে ছাতিম গাছটা। সেটাও ফুলে ফুলে ভরা। হাওয়া ছিল না কাল। গন্ধটা জমাট বেঁধে আছে সেখানেও।
একতলায় থাকি আমরা। অনেক আগে যখন আমরা একতলার ভাড়া বাড়িতে থাকতাম তখন মা রাস্তার ধারের জানলায় মাটির প্রদীপ রেখে দিতেন হেমন্তকালে। আমাদের এই ফ্লাটে দুটো বড় বারান্দা আছে। সেখানেই কয়েকদিন পর সন্ধে থেকে প্রদীপ জ্বালাতে বলেছি শম্পাকে। শেষ বয়েসে আর একবার সেই মিথই না হয় বিশ্বাস করি।
এমন শিউলি- ছাতিমের গন্ধ....। আকাশপ্রদীপ....। মা কি একবার আসবেন না তার ছোটছেলে কেমন আছে দেখতে? মেজদি? দাদা? বাবা কুঁড়ে মানুষ, আসবেন না। খবর নিয়ে নেবেন মা- দাদা- মেজদির কাছে। তবু ওই তিনজন এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেই জন্মসার্থক আমার। হোক না সে আমার ঘুমের মধ্যেই। সকালবেলা মাটিতে পড়ে থাকা শিউলি ফুল জানিয়ে দেবে ওঁরা এসেছিলেন ।
হেমন্তকাল বিষণ্ণতা আনে। কার্তিক মাস আনে আকাশপ্রদীপ ।
বাস্তবে না হোক স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসেন মা, বাবা, দাদা, মেজদি, ছোড়দা এমনকি ছোটবোনটাও।
তাই বা কম কিসের?
আজ ষোলই অক্টোবর
১৯৮০ সালে আজ ছিল সপ্তমী।সেদিন এই সময়েই মা. ........।